একজন জহিরুল। পেশায় ভ্যানচালক।মাঝে মাঝে স্কুলের সামনে ঝাল- মুড়ি বিক্রি করে।সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারে। আর বিদ্যার দৌড় নেই বললেই চলে। সংসারে লোক সংখ্যা একটু বেশী। লক ডাউনের কারনে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা।স্কুল বন্ধ থাকার কারনে শিক্ষার্থীর খোঁজ নেওয়ার সুবাদে তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়।তাও সেটা মার্চ মাসে। তারপর মাঝে মধ্যে তিনিই আমাকে ফোন দেন।অন্যান্য সব অভিভাবকের মত তিনিও বলেন-‘স্যার,স্কুল কবে খোলবে।মেয়েতো লেখাপড়া করছে না। সব যে শেষ হয়ে গেল।’
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে ধরে রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে অভিভাবকের সাথে ফোনে যোগাাযোগ করি।
-” হ্যা স্যার পড়ছে পড়ছে। পড়ছে তো। কোন চিন্তা করেন না।”- ” ওর কাছে দেন।”
-” ও স্যার, কোথায় যেন গেছে। ঘুমিয়ে পড়েছে।”ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমনও হয়েছে গত মার্চ থেকে অভিভাবককের মোবাইলে ফোনের পর ফোন দিয়েছি। রিসিভও করেনি। কল ব্যাকও করেনি। অন্য বিশ্বস্ত মাধ্যম দিয়ে যোগাাযোগ করার চেষ্টাও করেছি। ফলাফল শূন্য।অথচ অভিভাবক কিন্ত সচেতন! অন্ততঃ আমদের জহিরুল ভাইয়ের মত নয়।
আবার এমনও হয়েছে, মোবাইলে কথা বলেছি। ৩০০ টাকা কেনো পেলো – এর উত্তরও দিয়েছি। সেই মোবাইল নং- এ ম্যাসেজ দিয়ে মোবাইল চার্জে রেখে বাইরে গিয়েছি। কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরলেই আমার সহধর্মিণী মেডাম তো রেগে অগ্নিশর্মা।
-” কাকে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়েছো? কি ম্যাসেজ পাঠিয়েছো ? কি ব্যাপার? ”
ঘটনা একটু অনুধাবন করার পরই ঐ নম্বরে কল ব্যাক। এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
-” কেনো মোবাইলে ম্যাসেজ দেছেন? কি জন্য দেছেন? যতসব ফালতু ম্যাসেজ। ” বলতে বলতে call cut.
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কিছুক্ষণ পর অন্য মোবাইল থেকে কল -‘আপনি কেনো ঐ নম্বরে ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন?!’
শেষে পরিচয় দিয়ে ম্যসেজের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে রক্ষা!
ভাবলাম ম্যাসেজের এই কার্যক্রমের থেকেও ভালো হবে যদি ম্যাসেন্জার বা ইমুর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সাথে যদি সরাসরি যোগাাযোগ করা যায়।
সে উদ্দেশ্য নিয়ে অভিভাবকদের সাথে যোগাাযোগ শুরু। দেখা গেল বেশীরভাগ অভিভাবকই বিদেশী স্বজনদের সাথে Imo ব্যাবহার করে কথা বলে। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং নিকটতম প্রতিবেশীর সাথে কথা বলে বাকি শিক্ষার্থীদের Imo এবং messanger গ্রুপে সংযুক্ত করা হয়। বর্তমানে এককভাবে অথবা গ্রুপের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান।
কিন্ত জহিরুল ভাই? সে অন্যরকম। কিছুদিন পূর্বে আগুনে তার বসত বাড়ীটি আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছিল। জমি জমা একেবারেই নেই। নিরক্ষর বললেই চলে। লক ডাউনের এই বাজারে সেই সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। টানাপোড়নের সংসার।তারপরেও মোবাইলে নেট কিনে ভিডিও কলে কথা বলে।যখন গ্রুপে সবার সাথে আলোচনা করি, তখন সে নিজে মেয়ের পাশে বসে মেয়েকে উৎসাহিত করে। যদিও তথাকথিত সচেতন অভিভাবকের তুলনায় তার বিদ্যার দৌড় খুবই নগন্য। একবেলা না খেয়ে থেকেও সে তার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে সদা প্রস্তত।
মাঝে মাঝে খুব হতাশ হই। কিন্ত যখন দেখি জহিরুল ভাইরা নিজে না খেয়ে,জীবনের হাসি- আনন্দ সব বিসর্জন দিয়ে সন্তানের শিক্ষার জন্য সব কিছু উজাড় করে দিতে প্রস্তত তখন উৎসাহিত হই।আর কিছু না পায়, জহিরুল ভাইদের সহযোগিতা তো পায়। মনে শান্তনা পায়, তাদের সন্তানের শিক্ষার জন্য কিছু করার চেষ্টা তো করছি…….।
লেখকঃ সত্যজিত সর্মা, সহকারি শিক্ষক,
চন্ডিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝিনাইদহ।
প্রতিদিনেরসময়/সোহাগ
Leave a Reply