প্রায় তিন দশক আগের কথা, বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ চলছে তখন। এক বিখ্যাত পরিচালক ঠিক করলেন সম্পূর্ণ নতুন নায়ক-নায়িকা নিয়ে কাজ করবেন তিনি।
নায়িকা মোটামুটি চুড়ান্ত হলেও ছবির নায়ক কে হবে এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়লেন তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মিলছে না মনের মত নায়কের দেখা। এমন সময় খোশনূর আলমগীর নামক এক ব্যক্তি পরিচালক কে বলেন তার সন্ধানে একটা ভালো ছেলে আছে, সিনেমায় কাজ করতে চায়।
পরিচালক সাহেব ছেলেটির খোঁজ করলেন এবং প্রথম দেখাতেই নায়ক হিসেবে পছন্দ করলেন। ছেলেটিও তার অসাধারণ প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পেল,আর প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করে দিল সে। এমনকি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ আয়কারী ঢাকাই সিনেমার তালিকা করলেও দেখা মিলবে এই নায়ক অভিনিত ৩ টি সিনেমার নাম। সেই ছেলেটি আর কেও নয়,বাংলাদেশ চলচিত্রে ইতিহাস সৃষ্টিকারী নায়ক সালমান শাহ।
১৯৯৩ সালে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরেই ঢাকাই চলচিত্রে অভিষেক ঘটে তার,চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সাথে প্রথম জুটি বেঁধে অভিনয় করেন ‘কিয়ামত থেকে কিয়ামত’ ছবিতে। আর প্রথম ছবিতে অভিনয় করেই দর্শকদের প্রচুর প্রশংসা কুড়ান তিনি। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিতে থাকেন দর্শকদের।
সালমান শাহ অভিনিত সর্বাধিক সিনেমার নায়িকা ছিলেন শাবনূর। মোট ১৪ টি সিনেমায় জুটি বেঁধে অভিনয় করেন সালমান শাহ-শাবনূর। তাদের প্রথম সিনেমা ‘তুমি আমার’ মুক্তির পরেই দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে এই জুটি। রাজ্জাক-কবরী জুটির পর সালমান-শাবনূর জুটি এখন পর্যন্ত সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়ে আছে। এ জুটি অভিনীত ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ সিনেমাটি বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আয়কারি ২য় সিনেমা।
বাংলাদেশ চলচিত্রের আকাশে এক উজ্জ্বল ধুমকেতুর মত আবির্ভূত হয়েছিলেন সালমান শাহ। গ্ল্যামার,স্টাইল আর অভিনয় দক্ষতায় অতি অল্প সময়েই জয় করেছিলেন অসংখ্য মানুষের মন,হয়ে উঠেছিলেন নব্বই দশকের তরূণীদের স্বপ্নের নায়ক।
মাত্র সাড়ে তিন বছরের ফিল্ম ক্যারিয়ারে সর্বমোট ২৭ টি ছবিতে অভিনয় করেন,যার প্রায় সবকয়টি ছবিই ছিল ব্যবসাসফল। শুধু তাই নয় ফ্যাশনের দিক দিয়েও সালমান শাহ ছিলেন সেই সময়ের নায়কদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে।তিনি এতটাই ফ্যাশন সচেতন ছিলেন যে বর্তমান প্রজন্মের অনেক নায়কই এখনো ফলো করেন তাকে।
ঢাকাই সিনেমায় এক অনন্যতা দান করেছিলেন তিনি।সালমান মানেই প্রেম,হিট হিট সব গান,সালমান মানেই দারুণ সব রোমান্টিক গল্প,আর সেইসাথে সিনেমাহলগুলোতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। এভাবেই একের পর এক হিট সিনেমা আর ভক্তদের অফুরন্ত ভালোবাসায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন সালমান শাহ।কিন্তু হঠাৎ করেই ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবেই না ফেরার দেশে চলে যান নব্বই দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই নায়ক। তার মৃত্যু নিয়েও রয়েছে নানাবিধ গল্প।কেউ কেও বলেন,আত্মঘাতী হয়েছিলেন অভিমানী এই অভিনেতা। অন্যদিকে তার পরিবার,ভক্তদের দাবি হত্যা করা হয়েছে তাদের স্বপ্নের নায়ককে।যাহোক সালমানের মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেই আলোচনায় আমরা যাচ্ছিনা।
আমরা এখন দেখব মৃত্যুর পরের সালমান শাহ কে।সালমান চলে গেছেন ২ যুগ আগে। কিন্তু মৃত্যুর এত পরেও কমেনি তার জনপ্রিয়তা।এখনো ভক্তদের কাছে সমানভাবেই সমাদৃত হচ্ছেন তিনি। সেই সময়ের সালমান ভক্তরা এখনো সালমানকে নিয়ে প্রতিবছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যাচ্ছেন,সোশাল মিডিয়ায় সালমান শাহের নামে গ্রুপ,পেইজ পরিচালনা করছেন,সিলেটে সালমানের বাড়ি দেখতে যাচ্ছেন,কবর জিয়ারত করছেন। কেউ কেউ কবিতা লিখছেন প্রিয় নায়কের জন্য,কেউ আবার ব্যক্ত করছেন প্রিয় নায়ককে না বলা কথাগুলো,কারো কারো মাঝে এখনো দেখা যায় প্রিয় নায়ককে অকালে হারানোর বেদনা। কেউ কেউ আবার যত্নে রেখে দিয়েছেন প্রিয় নায়কের সেই সময়ের ভিউকার্ডগুলোও।
বর্তমান সময়েও সালমান শাহ একটি প্রিয় নাম।বেশ কিছুদিন আগেও একটি সিনেমায় নতুনভাবে দেখা যায় সালমান শাহকে। কীভাবে? ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পোড়ামন ২ সিনেমায় সালমান শাহের একজন সাধারণ ভক্তের চরিত্রে অভিনয় করেন এই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা সিয়াম আহমেদ। ছবিটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল সিনেমামহলে।
এছাড়াও গতবছর সালমান শাহের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঢাকার বিখ্যাত সিনেমা হলগুলোতে সপ্তাহব্যাপী তার অভিনীত সিনেমা দেখানোর আয়োজন করা হয়। এসময় হলগুলোতে তরুণদের উপচে পড়া ভিড় ই প্রমাণ করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সালমানের জনপ্রিয়তা।এই তরুণদের অনেকেই জন্মগ্রহণ করেছেন সালমান শাহের মৃত্যুর পর। তবুও নিজেকে সালমান ভক্ত বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তারা।
সালমান শাহের প্রথম ছবির’বাবা বলে ছেলে নাম করবে’গানটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। সেখানে সালমান শাহ বলেছিলেন সেরা কাজ করে,ইতিহাসে নাম লেখাবেন।সেটাই করে গেছেন তিনি।
বেশ কিছু মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হয় ৩ বছর বয়সী ছোট্ট এক সালমান ভক্তের ছবি । এই বাচ্চা ছেলেটি এখনো দুনিয়ার তেমন কিছুই বুঝে না। তবুও বড় হয়ে সালমান শাহ হতে চায় সে। এভাবেই হয়তো নায়ক সালমান শাহ যুগে যুগে চির অমর হয়ে থাকবেন তার ভক্তদের হৃদয় থেকে হৃদয়ে। আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন স্বপ্নের নায়ক হয়ে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ
প্রতিদিনেরসময়/এমএস
Leave a Reply