বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ। তরুণ জনগোষ্ঠী এখন ৪ কোটি ৫৯ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। কিন্তু এতো বেশি জনশক্তি ও যথেষ্ঠ কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকার পরও বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য জানা যায়। অন্যদিকে গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই বেকার।
দেশের মোট আটটি খাতে চাহিদার তুলনায় বর্তমানে শ্রমিক কম রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজারের বেশি। সঙ্গে রয়েছে মধ্যমসারির কর্মকর্তার সংকটও। আইএলওর হিসেবে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২০ লাখ লোক প্রবেশ করছে। এর মধ্যে কারিগরিভাবে দক্ষ জনবল বের হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ২শ। বাকি সবই অদক্ষ। আর তাদের অনেকের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলেও কারিগরি দক্ষতা নেই। ফলে অনেকেই চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অশিক্ষিত বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশ কম। অশিক্ষিতদের বিপরীতে হুহু করে প্রতিনিয়তই বাড়ছে শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা।
দেশে বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। তাই গত ১০ বছরে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। যা বেড়ে বর্তমানে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। ১০ বছর আগেও বছরে ২ থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতো। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে তারা চাকরি পাচ্ছে না। বেকারত্বের কারণে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি আতœহত্যার মতো পথও বেছে নিচ্ছে অনেকে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে চাকরি না পাওয়ার অন্যতম প্রধান করণ হচ্ছে চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা। দেশে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ের অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হলো এসব তরুণ প্রজন্মের চাকরি–উপযোগী শিক্ষার অভাব রয়েছে। যার অন্যতম দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতায় প্রতিনিয়তই আমরা হেরে যাচ্ছি।
ভয়াবহ অবস্থা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার। যুগ যুগ ধরে চলছে। বিশ্ব পরিবর্তন হলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আগের মতোই। পরীক্ষা আসছে ইংরেজি গ্রামার, প্যারাগ্রাফ, ডায়ালগ, লেটার। শিক্ষার্থীরা এসব মুখস্থ করছে। ভাল নম্বর পেয়ে পাস করছে। কিন্তু পাস করা সনদ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। এ সনদ দিয়ে হচ্ছে না কোন চাকরি। দেখা যাচ্ছে, এই সনদধারীদের একটি বড় অংশ ভালো করে ইংরেজিতে একটি চিঠি লিখতে পারে না। ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। অধিকাংশই বিদেশি বায়ারসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সামনে একটি প্রেজেন্টেশন দিতে পারে না। নেই তাদের মাঝে পরিবর্তিত প্রযুক্তিগত কোন জ্ঞান। ফলে পড়া-লেখা শেষ করেও মিলছে না চাকরি। এর অন্যতম কারণ, কোন বিষয়ই হাতে কলমে শিখছে না। শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহারিক চর্চা নেই বললেই চলে।
কোনো সন্দেহ নেই আমাদের দেশে দক্ষ মানবসম্পদ সংকট তীব্র। তবে তা পৃথিবীর কোন দেশেই থাকে না। তা তৈরি করে নিতে হয়। সে জন্য আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রয়োজন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী জনশক্তি তৈরির কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
আমাদের দেশে যেসকল বেকারদের আমরা অদক্ষ বলছি তাদের নিয়েই বিদেশিরা অনেক গুরুত্ব¡পূর্ণ পদে কাজ করাচ্ছেন। কিন্তু আমরা দক্ষ মানবসম্পদ পাচ্ছি না। তাই আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রবণতা বাড়াতে হবে। চাহিদানুযায়ী কাজের জন্য মানবসম্পদকে সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিবর্তিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দায় নিয়ে কার্যকর উদ্যেগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক ও সংবাদকর্মী
কাপাসিয়া, গাজীপুর
ছাপা হয়েছে:
দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা
২ অক্টোবর ২০২২, রবিবার
Leave a Reply