বাংলাদেশে মারাত্মক ছোঁয়াচে নতুন করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, ইচ্ছে থাকলেও অনেকেই তাদের শেষ বিদায়ের সময় থাকতে পারছেন না স্বজনরা। স্বজনদের এই অপারগতায় মৃতদেহ গোসল, কাফন-দাফন ও সৎকারে ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কিছু স্বেচ্ছাসেবক।
ঢাকার আল মারকাজুল ইসলামী নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ১৫ জনের একটি দল কোভিড-১৯ মৃতদের সৎকারে কাজ করে যাচ্ছে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া। পুরো দলটি মোহাম্মদপুরে সংগঠনের প্রধান কার্যালয়ে থাকছে এখন।
মৃতদেহ দাফন ও সৎকারে প্রথম দিকে ঢাকার বাইরে কিশোরগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জে সংগঠনের দুটি দল থাকলেও যেহেতু ঢাকায় মৃত্যুর হার বেশি, তাই তাদের সবাইকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে সংস্থাটি ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলেই কাজ করছে।
ঢাকায় কোভিড-১৯ এ মৃতদের দাফনের জন্য খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রথম দিকে মারা যাওয়া কয়েকজনকে আজিমপুর এবং মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও)প্রটোকল অনুসরণে বাংলাদেশে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর কোভিড-১৯ এ মৃতদের সৎকারের প্রক্রিয়া ঠিক করেছে, যেখানে সব ধর্মেরই বিধান মানা হচ্ছে। মৃতদেহের গোসল থেকে শুরু করে সৎকার পর্যন্ত পুরো কাজটি করা হচ্ছে কঠোর সাবধানতায়।
দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে মারকাজুল ইসলামীর কর্মী জুবায়ের হোসাইন বলেন, “সাধারণত মৃত্যুর সময়ে মানুষের কাছের লোকেরা তার সাথে থাকে, কিন্তু এই মৃত্যুটা এমনই এক করুণ মৃত্যু, যেই মৃত্যুতে খুব আপন লোকও কাছে আসে না, কিংবা আসতে চাইলেও আসতে পারে না,”।
সংগঠনটির যে কজন কর্মী এই দুঃসময়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের একজন জুবায়ের, যিনি তার পরিবার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন এই সময়ে, স্বেচ্ছায়।
জুবায়ের বলেন, “এই ব্যাপারটিই সবচেয়ে খারাপ লাগে ভাবতে, আমরা কত ভালো ভালো পরিবারের মানুষজনের লাশ নিয়ে যাচ্ছি দাফনের কাজে, অথচ তাদের কেউ ধরতে আসে না, আবার অনেক সময় কেউ কোনো খোঁজও নেয় না।”
বাসা থেকে লাশ বহনের কাজটি বেশি বেদনাদায়ক বলে জানান তিনি।
“বাসা থেকে যখন মৃতদেহ নিয়ে আসি, অনেকসময় তাদের আপনজনেরা কান্নাকাটি করেন, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তখন মানুষ হিসেবে আমরাও আবেগতাড়িত হয়ে যাই। হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ আনার সময় এই বেদনাদায়ক দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হয় না।”
মৃতদেহ বহন থেকে শুরু করে দাফন কিংবা সৎকারের সময়ে তাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে জুবায়ের বলেন, “একজন ডাক্তার যেভাবে রোগীদের চিকিৎসা করার সময়ে সুরক্ষা গ্রহণ করে, আমাদের ক্ষেত্রেও সেভাবে সুরক্ষিত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা গামবুট, পিপিই, হাতে সার্জিকাল গ্লাভস, মুখে মাস্ক এবং চোখে সার্জিকাল গগলস পরি, এভাবেই যতটুকু সম্ভব নিরাপদে থাকতে চেষ্টা করি।”
তাদের পিপিইগুলো একবার ব্যবহারের পর আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় বলে জানান তিনি।
কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই দেশের স্বার্থে নিজেদের এই কাজে উৎসর্গ করতে গিয়ে পরিবারের যথেষ্ট সমর্থন পান জুবায়ের।
তিনি বলেন, “প্রথমদিকে এই কাজ করার সময় পরিবারকে না জানিয়েই বের হতাম, পরে যখন পরিবারের লোকেরা জানতে পারল, তখন তারা ভয় পেলেও বাস্তবতাকে স্বীকার করে মেনে নিয়েছে। পরিবারের প্রত্যেকেই বলে এটা পূণ্যের কাজ কিন্তু নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারটাও নিশ্চিত করার পরামর্শ দেয় তারা।”
সংগঠনের আরেক কর্মী আবদুল্লাহ সাদেক বলেন, “আমরা এই কাজটি মানবিক কর্তব্যবোধ থেকেই করি। অনেক সময় দেখা যায় মৃত ব্যক্তির আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠরা কাছে আসার চেষ্টা করে, অনেকেই জানাজায় শরীক হতে চায়। কিন্তু আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই না থাকায় আমরা তাদের এই অনুরোধ রাখতে পারি না। এই ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক মনে হয়।
“অনেকে দূর থেকে বার বার ফোন করে তাদের স্বজনদের কোথায় দাফন করা হল, সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে কিনা- এসব জানতে চায়, অনেকে কান্নাকাটি করেন। তাদের জায়গায় যখন নিজেদের কল্পনা করি, তখন এই বিষয়গুলো আমাদের মর্মাহত করে।”
আল মারকাজুল ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হামজা শহিদুল ইসলাম জানান, করোনায়ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো মৃতদেহ দাফন কিংবা সৎকার কোনো সংস্থা করতে না চাইলে তাদের সংগঠন সরকারের অনুমোদন নিয়ে কাজটি করে দেয়।
মৃতদেহ বহন এবং সৎকারের প্রক্রিয়া বিষয়ে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর পাঠানো হয়। এরপর যেখানে মৃতদেহ রয়েছে সেখানে গাড়িসহ ৫-৬ জনের একটি টিম পাঠানো হয়। এর মধ্যেই ডেথ সার্টিফিকেট থেকে যখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মৃত ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিল কিংবা এলাকাবাসীর সন্দেহ থাকে ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিল, তখনই সেই লাশ বহন করে গোসল করানোর পর জানাজা এবং দাফন করা হয়।”
মৃত ব্যক্তি অন্য ধর্মের হলে সেভাবেই সৎকারের ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে জানিয়েন হামজা শহিদুল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত তারা আটজন হিন্দু ধর্মালম্বীর মরদেহ সৎকারে সহায়তা দিয়েছেন।
সরকার থেকে তাদের কর্মীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই, গামবুট, গ্লাভস, গগলস, মাস্ক, জীবাণুনাশক ইত্যাদি উপকরণ নিয়মিত সরবরাহ করা হয় বলে জানান তিনি।
১৯৮৮ সালের বন্যার পর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে আল মারকাজুল ইসলামীর প্রায় ৫ হাজার সদস্য উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনেও সংগঠনটি ভূমিকা রেখেছে বলে জানান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।
Leave a Reply