এম.দুলাল উদ্দিন আহমেদ: আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন,স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি নানা রকম আধুনিক সামগ্রী।
এ কারণে চাহিদা কম,কাঁচামালের দুস্প্রাপ্যতা ও চড়ামূল্য,সর্বোপরি পুঁজির অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সলঙ্গার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।
ইতিহাসের ঐতিহ্যের পাতায় চোঁখ রাখলেই দেখা যাবে,মৃৎশিল্পের জন্য সলঙ্গায় একসময় ছিল খুবই পরিচিত। কিন্তু কালের আবর্তে আজ তা বিলীন হতে চলেছে। ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে এ পেশার আকাল। হয়তো বা এমন দিন আসবে,যেদিন বাস্তবে এ পেশার অস্তিত্ব মিলবে না। শুধুমাত্র খাতা-কলমেই থাকবে সীমাবদ্ধ।
সলঙ্গার গোঁজা,চরবেড়া ও ঘুড়কা বেলতলা এলাকার শতাধিক মৃৎশিল্পী পরিবারে বর্তমানে অভাব-অনটনে দিন কাটছে। ইতোপূর্বে অভাব ঘুচাতে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে জড়িয়ে পড়ছে অন্য পেশায়। জানা যায়,এক সময়ে সলঙ্গা থানা এলাকায় প্রায় শতাধিক পাল পরিবার মৃৎশিল্পের এই পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল।
থানার বড়গোঁজা ও ঘুড়কা বেলতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়,এ পেশার অনেকেই এখন পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়ে কেউ বা রিকসা চালান,আর কেউ বা দিনমজুরের কাজ করছেন। যারা এ পেশা ছাড়তে পারেননি, তাদের অনেকেই শিক্ষা,চিকিৎসাসহ আধুনিক জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছেন। মৃৎ শিল্পীরা জানান, বর্তমানে মানুষের ব্যবহারিক জীবনে মৃৎশিল্পের আর বিশেষ ভুমিকা নেই।
একটা সময় ছিল যখন মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন,সানকি,ঘটি, মটকা,সরা চারি,কলস, সাজ,ব্যাংক,প্রদীপ,পুতুল,কলকি,দেবদেবীর মূর্তি ও ঝাঝরের বিকল্প ছিল না। ঋণ প্রদানে অনীহা ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রযুক্তি বিকাশের এ যুগে এ শিল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত না হওয়ায় তা আজ আর প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
ফলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আগেকার দিনে মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন এঁটেল মাটি,রঙ,যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি ছিল সহজলভ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের দুর্মুল্যের কারণে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। পূর্বে যেখানে বিনামূল্যে মাটি সংগ্রহ করা যেতো, বর্তমানে সেই মাটিও অগ্রিম টাকায় কিনতে হচ্ছে।
সাধারণত মৃৎপাত্রগুলো কুমার পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়ে মিলেমিশে তৈরি করে থাকেন। তৈরিকৃত সামগ্রী বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে কিনে নেন। অনেকে আবার বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করেন। মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য আজ বহুলাংশে বিলুপ্ত হচ্ছে। শুধু সলঙ্গায়ই নয়,গোটা দেশে এ পেশায় নেমে এসেছে এক চরম বিপর্যয়।
এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ এ শিল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবো,তেমনিভাবে প্রাচীন সভ্যতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ পেশাটি। সেই সাথে এর মাঝেই জাতির প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
Leave a Reply