1. admin@protidinershomoy.com : admin :
  2. nasimriyad24@gmail.com : ডেস্ক রিপোর্ট : ডেস্ক রিপোর্ট
  3. wp-configuser@config.com : James Rollner : James Rollner
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন

“যে হৃদয় খুঁজে ভালবাসা”

সংবাদ দাতার নাম
  • সময় : শুক্রবার, ৫ জুন, ২০২০
  • ৫৫৪ জন পড়েছেন

সারওয়ার চৌধুরীঃ

আট ঘন্টার সাথে আরও পাঁচ ঘন্টার ওভার টাইম । শরীর , মন কিছুই আর তর সইছিলো না …. শক্রবার রাত , মনের মধ্যে নির্মল প্রশান্তি যে নেক্সট দুইদিন আর সকাল সকাল কাজে আসার জন্যে তাড়াহুড়ো করতে হবেনা , স্ট্রেসমুক্ত থাকবো , একরাশ খুশির ঝিলিক নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেব , এমন সময় দেখলাম মাইকেল নামের ছেলেটা এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসে আছে । প্রচণ্ড রাগে আমার ভেতরটা ফুসে উঠলো — এই বারো বছরের ছেলেটার জন্যই সারাটা দিন আমার উপর দিয়ে প্রচণ্ড ঝাকুনি গেছে —– সকালে স্কেনিংয়ের সময় মাইকেল যখন ওয়াক থ্রো পার হচ্ছিল , তখন মেশিনের সব কটা লাইট জ্বলে উঠে — কিছুদিন আগে একজন ছাত্রের হাতে আরেকজন ছাত্র খুন হওয়ার পর থেকে আমাদের উপরে সবার নজরদারী যেন একটু বেশী , তার উপর আবার সর্বত্র ক্যামেরা আতঙ্ক । ” হোয়াই ইউ লাইটিং আপ সো হাই ? চেক ইউর সেলফ প্লীজ । ” আমি তাকে বললাম । ” নাথিং ” প্রচণ্ড বিরক্তি আর অবজ্ঞার সাথে সে আমাকে জানায় । ” ইয়াংম্যান , ইফ ইউ লাইটিং আপ লাইক দিছ , ইউ হেভটু গো এগেইন থ্রো দ্যা মেশিন অর ইউ হেভটু টেইক হ্যান্ড সার্চ । ” কিছুটা রাগ্বত স্বরে তাকে আমি জানালাম । প্রচণ্ড রাগ আর বিরক্তির সাথে খেদোক্তি করে সে সব মেটাল ইন্সট্রুমেন্ট বাক্সে রেখে ওয়াক থ্রো করল , এভাবে প্রায় প্রতিদিনই ছেলেটা বিরক্তিকর আচরণ করে । মনে মনে বলি বেটা তোর ভাগ্য ভাল যে এমেরিকায় জন্মেছিস , বাংলাদেশ হলে ডান্ডিয়ে তর মত বাছাধনকে ঠিক করে ফেলতাম । রাগটাকে সামলিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম ” থ্যাংক ইউ ” ।

ব্রেকটাইমে লাঞ্চ খেতে যাব , তখন সুপারভাইজার রেডিওতে জানাল অফিস রুমে গিয়ে ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজগুলো চেক করতে , মাইকেল নামের সেই ছেলেটা মিসিং হয়েছে । বিষণ রাগ হচ্ছিলো মাইকেলের উপর । এখন আমাকে ক্যামেরা চেক করতে হবে , সেন্ট্রালে কল দিতে হবে , অসংখ্য পেপার ওয়ার্ক করতে হবে —- মগজের চরম অবস্হা নিয়ে অফিস রুমে একটার পর একটা ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ চেক করছি , ঠিক তখন সুপারভাইজার আবারও রেডিওতে জানাল ছেলেটাকে স্কুলের ভেতরেই একটা নিরিবিলি রুমে লোকানো অবস্থায় পাওয়া গেছে … ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা । যাইহোক কিছুটা স্বস্তি পেলাম , পেপার ওয়ার্ক আর বসদের বিভিন্ন অস্বস্তিকর প্রশ্নবান থেকে এ যাত্রায় মুক্তি পাওয়া গেল ।

এখন বাড়ী যাওয়ার সময় আবার সেই ঝামেলা , আবার সেই একরোখা বেয়াদব মাইকেল । অনেক কষ্টে রাগটাকে দমন করে কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম , “এখনও তুমি এখানে , বাড়ী যাচ্ছনা কেন ? ” নিচুমাথাটা তুলে লজ্জিত ভাবে আমার দিকে তাকালো , ওর চাহনিতে এই প্রথম যেন আমি অন্যরকম একটা অনুভূতির পরশ পেলাম — আমি কিছু বলার আগেই কাতরভাবে বলল ” মি: চৌধুরী , সকালের আচরণের জন্যে আমি দুঃখিত । স্কেনিংয়ের পরে যখন ক্লাসে যাই , তখন বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসা হাসি করছিল , আমার শরীরে নাকি গন্ধ , জামা ময়লা , আমি কুৎসিত , কেউ আমাকে পছন্দ করেনা , ভালবাসে না …. ওদের এরকম আচরণের কারনে আমি ক্লাস থেকে বের হয়ে বাথরুমে লুকিয়ে থাকি , সবাই খোঁজা-খোঁজি করে বাথরুম থেকে বের করে নিয়ে আসে , প্রিন্সিপাল আমার বাবাকে খবর দিলে তিনি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে যান । ” একশ্বাসে এতগুলো কথা বলে মাইকেল একটু দম নেয় । ওর কাতরভাবে কথা বলা দেখে আমার রাগ অনেকটাই কমে গিয়েছিল , উপরন্ত এখন তার চেহারার মধ্যে যেন একটা মায়াবী আভা ফুটে উঠেছে , যে ছেলেটাকে একদমই সহ্য করতে পারতাম না , যাকে সবসময় মনে হত নোংরা একটা বখাটে , বেয়াদব ছেলে , তার প্রতি কেন জানি অন্যরকম একটা মায়া অনুভব করলাম । ” বাবা যখন বাড়ীতে নিয়ে গেলেন তখন এতরাতে আবার বাইরে আসলে কেন ? আর তোমার মা ই বা কোথায় ? ” আমি জানতে চাইলাম । বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত ওর দুটো চোখ ছলছল করে উঠে । ” আমার মা এখনও কাজে , বাড়ীতে যাওয়ার পর বাবার প্রচণ্ড রাগ দেখে ভয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে যাই , লাঞ্চের আগে স্কুল থেকে চলে আসায় এখন পর্যন্ত কিছু খাওয়া হয়নি । ” আমি এতক্ষণ মাইকেলের কথাগুলো শুনছিলাম , ওর বয়সী আমারও ছেলে আছে , নিজের উপরে নিজেরই প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে , কথা না বাড়িয়ে তাকে নিয়ে গেলাম রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টটায় । বললাম ” তোমার যা ইচ্ছে খাও ” আমার কথায় তার চেহায়ার মধ্যে অদ্ভুত মায়াবী এক আনন্দ ঝিলিক ফুটে উঠে । ছেলেটা খাচ্ছে আর আমি তার দিকে চেয়ে আছি , ভালবাসাময় অন্যরকম এক ভাললাগায় যেন আমি আচ্ছন্ন , ওর খাওয়া শেষ হতেই রেস্টুরেন্ট থেকে দুজনে বেরিয়ে আসলাম । রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য ত্রিশের একজন মহিলাকে দেখিয়ে মাইকেল বলল ” ঐ যে আমার মা দাঁড়িয়ে আছেন । ” সামনে যেতেই মা প্রচণ্ড স্নেহের আবেশে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন ” আমি তোকে এখানে না দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম । ” —-আমি তো মনে করেছিলাম খুব রাগ করে মা জানতে চাইবেন কেন সে এত রাতে এখনও বাড়ী যায়নি ? কিন্তু না মনে হল এ প্রশ্নটা মায়ের কাছে অবান্তর , কেন সে বাড়ী যায়নি , মায়ের যেন সেটা ভাল করেই জানা । মাইকেল আমার দিকে ইশারা করে মাকে জানায় ” ইনি মি:চৌধুরী , আমাকে পেট ভরে ডিনার খাইয়েছেন । ” মায়ের দৃষ্টি এবার আমার দিকে ,চাহনীতে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা –” আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মি: চৌধুরী । ” আমিও মহিলাকে ধন্যবাদ বলে নিজের ভেতরে ঘূর্ণিত একটা জিজ্ঞাসা সংবরণ করতে না পেরে জানতে চাইলাম ” যদি আপনি মাইন্ড না করেন , তবে একটা কথা জানতে চাই ।”
———-” জ্বী বলেন “——–
” আপনি কি জানেন , কেন এত রাত পর্যন্ত মাইকেল বাড়ী যায়নি ? ” —- দেখতে পেলাম , লজ্জা আর সংকোচে মহিলার গাল দু খানা অনেকটাই লাল হয়ে গিয়েছে । ” মি: চৌধুরী, বাড়ীতে মাইকেলের সৎ বাবা , তিনি তাকে পছন্দ করেন না এমনকি সহ্যও করতে পারেন না , ছেলেটার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার বাবার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে যায় , তারপর থেকে আপন বাবাও ছেলেটার খোঁজ – খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনা , এত বড় পৃথিবীতে আমিই তার একমাত্র আপনজন । তার বাবা কিংবা সৎবাবা কেউই দায়িত্ব না নেয়ায় আমাকে বাধ্য হয়েই কাজ করতে হয় । মাইকেলের বাবার সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর শুধু ছেলেটার কথা চিন্তা করেই আবার বিয়ে করেছিলাম ।” এতগুলো কথা বলে ভদ্র মহিলা একটু বিরতি নেন , চোখ দুটো ছলছল করছে , কতদিনের না বলা কথাগুলো বলতে পেরে ভেতরে জমে থাকা দুঃখের যন্ত্রণা গুলো যেন গলে গলে চোখের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ——– ” লোকটার সাথে আমার আরও একটা ছেলে ও একটা মেয়ে আছে । ” ভদ্র মহিলা আবারও শুরু করলেন —— ” ঐ সন্তানগুলো হওয়ার পর থেকেই সে ধীরে ধীরে মাইকেলকে ঘৃণা করা শুরু করে , আমিও ঐ দুটো সন্তানের কথা চিন্তা করে লোকটার সাথে আছি । মাইকেলের মত তাদেরকে ও পিতৃস্নেহ হীন করতে চাইনা । ” এক নাগারে কথাগুলো বলে মাইকেলের মা থামলেন , কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে রাখা ট্যিসু দিয়ে চোখের উপর দিয়ে আসা এতদিনের অব্যক্ত বেদনার জলগুলো মুছতে লাগলেন । আমিও কোন শব্দ খোঁজে পাচ্ছিলাম না তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার । সন্তানের স্বার্থে মায়েদের ত্যাগের কোন তুলনা হয়না , একমাত্র মায়েদের পক্ষেই সম্ভব এরকম নিঃস্বার্থ ত্যাগের মহিমা সৃষ্টি করা । আর মাইকেল , যে ছেলেটাকে তার বাহ্যিক আচরণ দেখেই বিচার করতাম , সেই মাইকেলকে এ মুহুর্তে আর বিরক্তিকর , নোংরা কিংবা বেয়াদব মনে হচ্ছেনা — যেন আমার ছেলেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে , আর স্হির থাকতে পারলাম না , দু হাত বাড়াতেই মাইকেল আমাকে জড়িয়ে ধরল , আমি বুঝতে পারছিলাম ভালবাসার তৃষ্ণা , না পাওয়ার বেদনা , মানুষের ঘৃণা আর নেতিবাচক আচরণ তার কোমল শিশু হৃদয়ে যে পাথর হয়ে জমেছে , সেগুলো যেন গলে ঝরছে । মাইকেল যে কত সুন্দর আর বড় মনের অধিকারী সেটা আগে কখনও উপলব্ধি করতে পারিনি , তা নাহলে যে সৎবাবা সবসময় মাইকেলকে ঘৃণা করেন , বাজে ব্যবহার করেন তাঁর সম্পর্কে একটিবারের জন্যেও সে কোন বাজে শব্দ ব্যবহার করেনি , একবারের জন্যে বলেনি যে লোকটি তার সৎবাবা । আমাদের সাথে মাঝেমধ্যে যে বিক্ষিপ্ত আচরণ করে সেটা হয়তোবা তার কোমল হৃদয়ের ভালবাসা না পাওয়ার হাহাকার । স্বার্থহীন ভালবাসা দিয়েই আমরা মাইকেলের মত শিশুদের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের চপলতাকে দূর করতে পারি । শিশুদের বাহ্যিক আচরণের মাধ্যমে বিচার না করে খুঁজে বের করতে হবে পেছনের কার্যকারণ গুলো । আমাদের একটু ভালবাসা , একটু স্নেহ , মনোযোগ পেলে হয়তো মাইকেলরা তাদের সমস্ত দুঃখ বেদনা ভুলে , তাদের মনে লুকানো কথাগুলো আমাদের কে বলতে পারে আর আমারও তাদেরকে সমাজের আবর্জনায় রূপান্তরিত হওয়া থেকে উদ্ধার করে সম্পদ হিসেবে পেতে পারি।

মা – ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ী স্ট্রাট দিলাম , গাড়ী ছুটছে আর আমার মাথায় ছুটে বেড়াচ্ছে মাইকেল ভাবনা। এভাবে অগণিত মাইকেল আর তাদের মায়েরা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। তাদের অমিমাংসিত অসংখ্য সমস্যার সমাধান হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে আমরা করতে পারবনা , কিন্তু অন্তত মানবিক ভাবে ভালবাসাপূর্ণ সহানুভূতি নিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারি , যাতে পৃথিবীর সবাইকে তারা হৃদয়হীন , ভালবাসাহীনদের কাতারে না দেখে , আর এভাবে কিছুটা হলেও তাদের হৃদয়ে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা – ভালবাসা , কৃতজ্ঞতাবোধ উদয় হবে , তারা নিজেদেরকে আর অসহায় মনে করবে না।

সংবাদটি আপনার সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার দিন

এই ক্যাটাগরীর আরোও সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশেষ সংখ্যা

%d bloggers like this: